“আমি সৈনিক আমার হাতে অস্ত্র আছে । কাজেই আমার পিছু হটার প্রশ্নই আসে না। আমি আগে বাড়াই, খোদা হাফেজ”। দুইটি পদক্ষেপ সামনে আগাইয়া গিয়া সে আবার বলিল, “ট্রেনিং নিয়া আসিয়া স্বাধীনতার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিয়া লড়াই করিও । তোমাদের কাছে ইহাই আমার দাবী”
উপরের কথাগুলিই ছিল শেখ আলিম উল্লাহ চৌধুরীর শেষ কথা । অস্রুসজল অথচ দৃপ্ত দৃষ্টির অহংকারমন্ডিত চোখে আলিম উল্লাহর প্রতিটি সঙ্গীই বলিয়াছে যে, সেই চরম মুহূর্তে তাহার কন্ঠস্বর ধ্বনি কে দুরাগত দৈববানীর মত শোনাইতেছিল।বিদায় নিবার পূব মুহূর্তে সকলেই যখন কিংকর্তব্যবিমূড়, তখন দ্বিধাদন্ধলেশহীন কন্ঠে আলিম উল্লাহ তাহার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ।
আমি একজন যদি না মরি তাহা হইলে দলের কেহই বাঁচিবে না । যাহা বলিলাম তাহা করিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা করিও । তবে ট্রেনিং নিয়া আসিয়া আজকের এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির পশ্চাদপদতা পোষাইয়া নিও । মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করার তীব্র বাসনায় উদ্দীপ্ত ২৮৬ জন তরুণ সাবরুমের প্রায় আড়াই মাইল দক্ষিণে আটকা পড়িয়াছে। অস্ত্র চালনার ট্রেনিং গ্রহণের জন্য তাহারা শিবিরে গমন করিতেছিল। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী, তাহাদের সহযোগী রাজাকার ও মিন্জোরা পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরিয়ে বেড়াইতেছে। ছোট বড় সকল গিরিপথ বন্ধ করার জন্য। বাংলার তরুণ অস্ত্র চালনা শিক্ষার জন্য পাগল। কোন প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা নাই। গমনা গমনের বেলায় নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা ও বারবার তাগদা দেওয়া সত্ত্বে ও গড়িয়া তোলা হয় নাই খবরা খবরের কোন নিশ্চয়তা। নাই প্রতিটি মুহূর্তে নির্মম অসহায় মৃত্যুকেই সম্মুখে রাখিয়া আমাদের তরুণ আপোষহীন মনোভাব নিয়া নিশংকচিত্তে স্বীয় লক্ষ্য হাসিলের জন্য আগাইয়া চলিয়াছে।
হাটহাজারী থানার গুমানমর্দ্দন ইউনিয়নের দামাল ছেলে শেখ আলিম উল্লাহ চৌধুরী। পিতা- শেখ আমজাদ আলী শাহ (রাঃ)। শেখ আমজাদ আলী শাহ (রাঃ) এর দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে আলিম ছিল সবার ছোট। তখন তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অনার্সে পড়ুয়া ছাত্র ছিলেন। তখনকার সময় তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজের জিএস , মুক্তিযুদ্ধাকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী সহ তাহার নিয়ন্ত্রণে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপ লিডার ছিলেন। তাহার আবার ফিরিয়া আসার কথা।
কিন্তু যাহার হাতে এইসব ছেলেকে তুলিয়া দেওয়ার কথা সে আসে নাই। হয়ত কোন বিপদ ঘটিয়েছে । নষ্ট করার মত সময় নাই বলিয়া আলিম প্রথমে নিজেই চলিল । পাহাড়ি পথ, গাছতলায় কাটে রাত । তবু ছেলেরা নবজীবনের আশায় উদ্দীপ । পাহাড়ীকাগণকে তাদের টাকা পয়সা দিয়া তোয়াজ করিয়া পাকবাহিনী, রাজাকার , মিজোদের গতি-বিধির খবর জোগাড় করিতে হয়।
২২ আগস্ট ১৯৭১ । আলিমেরা তখন বাংলাদেশ সীমানার আড়াই মাইল ভিতরে। আর মাত্র কিছুক্ষণের পথ । ক্লান্ত ছেলেরা একটি ছোট্ট বোঝার তীরে বিশ্রাম করিতেছিল । সেখানে অন্যান্য জেলার ও বহু লোক সমবেত । তাহাদের মোট সংখ্যা ২৮৬ জন বলে পরে জানা যায়।অদূরে একটি ইক্ষুক্ষেত হইতে ছেলেরা ইক্ষু নিল । সংগ্রামীদের কঠিন জীবনের স্বাদ উপভোগ করিতে করিতে তাহারা ইক্ষু চিবায় । একজন পাহাড়ী আসিয়া জানায় যে ইক্ষুর দাম কম হইয়াছে । আলিম ইক্ষুর দাম বাবদে ত্রিশ টাকা দিয়া পাহাড়ীকে সন্তুষ্ট করিল । ইহারা বড় কাজে আসিয়াছে । সুতরাং নাখোশ করিলে চলিবে না । খুশি মনে সেই পাহাড়ী ফিরিয়া চলিল । কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া নিজেদের ভাষায় সে চাপা কন্ঠে বলিল, “এই বাঙ্গালী মানুষ পান্জাবী মানুষ আইয়ে । “কঠিন মূহুর্ত । হয় জীবন নয় মৃত্যু । ট্রেনিং প্রাপ্ত আছে তাহারা মাত্র দুই / তিনজন । যাবার সময় আলিম একটি মাত্র গ্রেনেড সঙ্গে নিয়েছিল । অস্ত্রের বড় অভাব । কিছু ভাবিতে না ভাবিতেই দাঁড়ের মত বুলেট মাথার উপর দিয়া ছুটিতে লাগিল । ঝোপঝাড় খানখান । তাহারই দায়িত্ব মহা দায়িত্ব,মানবতার দেশের খাতিরে দায়িত্ব । হামাগুড়ি দিয়া কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই আলিম হাতে ধরা শক্তিশালী গ্রেনেড ছুড়িয়া মারিল । বিকট শব্দ, একটি তীব্র অগ্নি শিখা,গাড়ধুম্রজাল সঙ্গে সঙ্গে বহু রাউন্ড বুলেট । আলিমের দেহ লুটাইয়া পড়িল । পরে
তাহার একজন সঙ্গী জানায় যে সে পিছনে ছিল এবং আলিমকে দেখা যাইতছিল । বুলেট বিদ্ধ অবস্হায় ও আলিম পিছনের দিকে তাকাইয়া তাহার সঙ্গীরা কতদূর অগ্রসর হইল তাহা দেখার চেষ্টা করিয়াছিল ।সঙ্গীদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে সে ওয়াকিবহাল হইতে পারিয়াছিল কিনা কে জানে।
সুশিক্ষিত হানাদার বাহিনী সে মুহূর্তে অগ্রসর না হইয়া পজিশন নেয় । কিছুক্ষণ
মাত্র সময় । অন্যান্যরা রেহাই পাইল । তবে সেখানে আলিমের সঙ্গে আরো দুইজন শহীদ হয় । একজনের নাম দলিল,আরেকজনের নাম শামসুল আলম ।
শেখ আলিম উল্লাহ চৌধুরীর বড় ভাই শেখ আহম্মদ উল্লাহ চৌধুরী ভ্রাতার মৃত্যু সংবাদ পাইয়া ও সেই সময় অতিকষ্টে গোপন রাখেন, যাতে তরুণদের মনে হতাশা না আসে । গুমানমর্দ্দন ইউনিয়ন কাউন্সিল শহীদ আলিম উল্লাহর স্মরণে জিলা কাউন্সিল ২নং সড়কের নাম শহীদ আলিম উল্লাহ সড়ক রাখার প্রস্তাব করিলে স্থানীয় জনগণ তখন তাহা সানন্দে গ্রহণ করিয়াছিলেন ।
আলিম জীবন দিয়েছে, প্রিয় মাতৃভূমিকে সে সবচেয়ে দামী উপহার দিয়ে গেল । সৈনিক সুলভ মনোভাব, অগাধ দেশপ্রেম, সঙ্গীদের প্রতি অতুলনীয় দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়নতার অতুলনীয় অবদান আলিম উল্লাহ দেখিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরবের বিষয়।
দেশপ্রেমিক দুঃসাহসী বাঙ্গালী যুবকের চিত্ত অালিমের মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া তাহাদিগকে অনুপ্রেরণা যোগাইবে।
আলিম নাই কিন্তু আলিমের মাতৃভূমি আজ স্বাধীন । স্বাধীনতার আনন্দে দীপ্ত আলিমের সংঙ্গী সাথীদের চোখ আলিমের কথা উঠিতেই কিন্তু অশ্রু সজল হইয়া উঠে। তাহারা বলে, আলিম মরিতে পারিয়াছে এবং জানিয়াছে বলিয়াই আমরাই স্বাধীন দেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছি। আলিমের বড় সাধ ছিল গণবাহিনী গড়িয়া তুলিবার।
দেশের মাটি ও মানুষ উভয়ের মুক্তির জন্যই সে হাতিয়ার তুলিয়া নিয়েছিল এবং অকাতরে রক্ত দিল । দেশের জন্য উৎসর্গ করলো জীবন। বাংঙ্গালী খুঁজে পেল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের একটি পতাকা, বিশ্ব মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হলো “বাংলাদেশ” নামক একটি রাষ্ট্র।
Leave a Reply